দেশের দীর্ঘতম বরিশাল-ভোলা সেতুর কাজ শুরু শীঘ্রই
দখিনের খবর ডেস্ক ॥ দ্বীপ জেলা ভোলাকে বরিশালের সঙ্গে যুক্ত করতে তেঁতুলিয়া নদীর ওপর দিয়ে দেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। যা নির্মাণাধীন পদ্মাসেতুর (৬.১৫ কিলোমিটার) ব্যয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। তবে, সেতুটির নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) জানিয়েছে, তারা সেতু নির্মাণের জন্য জরিপ করেছে এবং সেতুর সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করেছে। সেতুটি নির্মিত হলে দক্ষিণের এই দুটি জেলার মধ্যে যাতায়াতে সময় কম লাগবে এবং ভোলা থেকে গ্যাস সরবরাহ করা সহজতর হবে। সাম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত হোসেন একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, “আমরা এই সেতু নির্মাণে অর্থায়নকারী খুঁজছি।” তিনি জানান, শিগগিরই তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) চিঠি দিয়ে সেতুর তহবিল সংগ্রহের জন্য অনুরোধ করবেন। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ বিবিএর তিনটি প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এবং ভোলা সেতু তার মধ্যে একটি। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জরিপ ও আলোচনার ভিত্তিতে ভোলার ভেদুরিয়া ফেরিঘাট এবং বরিশালের লাহারহাট ফেরিঘাট বরাবর সেতুটি বানানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, ১০ কিলোমিটার সেতুর মধ্যে প্রায় ৩ কিলোমিটার শ্রীপুর চরের ওপর দিয়ে যাবে। বিবিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী মুহাম্মদ ফেরদৌস গণমাধ্যমকে বলেন, এই সেতু দিয়ে ভোলা থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেতুটি দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করার সুযোগ থাকবে। এর আগে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছিলেন, ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্রের প্রায় ৩২ কিলোমিটার উত্তরে ভেদুরিয়া ইউনিয়নে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেছিলেন, গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার পর, ভোলার গ্যাসের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুটে। ব্যবসা ও যোগাযোগের উন্নয়নে সেতু: বরিশাল বিভাগের পূর্ব অংশ ভোলা জেলা। তেঁতুলিয়া নদী একে মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করেছে। প্রায় ৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার আয়তন এবং প্রায় ২০ লাখ ৩৭ হাজার জনসংখ্যার জেলা ভোলার সঙ্গে বরিশালের সরাসরি স্থল যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। ভোলা যাওয়ার একমাত্র উপায় নদীপথ। নদীপথে বরিশাল থেকে ভোলার ভেদুরিয়া যেতে লঞ্চে প্রায় দুই ঘণ্টা এবং স্পিডবোটে প্রায় ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগে। ভেদুরিয়া থেকে ভোলা সদর উপজেলায় যেতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। বরিশালের লাহারহাট ফেরিঘাট থেকেও লঞ্চে ভেদুরিয়া যাওয়া যায়। এই ঘাট থেকে ভোলার ইলিশঘাট পর্যন্ত একটি ফেরি চলাচল করে। সেতুর সম্ভাব্যতা জরিপের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভোলা থেকে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন নৌকা ও লঞ্চের উপর নির্ভরশীল। যা এই জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলছে। ভোলার একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা দীপক কুমার অধিকারী। তার পরিবারের সদস্যরা বরিশালে থাকেন। তিনি জানিয়েছেন, “যদি সেতু হয় তাহলে আমার মতো অনেকেই প্রতিদিন বরিশাল থেকে যাতায়াত করে কাজ করতে পারবেন।” একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মানিক গুপ্ত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খারাপ আবহাওয়ার কারণে ফেরি চলাচলে সমস্যা হলে মাঝে-মাঝেই তারা বরিশাল থেকে ভোলায় ওষুধ পাঠাতে সমস্যায় পড়েন। ভোলার একাধিক ব্যবসায়ীও জানিয়েছেন, সেতু না থাকায় তাদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। চরফ্যাশন উপজেলার একজন ব্যবসায়ী আব্দুল গনি বলেছেন, “সেতু হলে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে।” সেতুর সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়েছে, “সেতুর কাজ শেষ হলে ভোলা এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারীদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি হবে। সেতু প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।” কাজের অবস্থা:: গত বছর ৫ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, খুব শিগগিরই বরিশাল-ভোলা সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হবে। তিনি রাজধানীর সেতু ভবনে সেতু বিভাগ এবং বিবিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেছিলেন, সেতুর ডিপিপির (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফর্মার কাজ চলছে এবং অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা চলছে। চীন প্রকল্পটিতে অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছিল বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে শুরু করে সেতুর সম্ভাব্যতা জরিপ গত বছরের আগস্টে শেষ হয়েছিলো জানিয়েছেন বিবিএর এক কর্মকর্তা। এই জরিপ সম্পন্ন করেছে ভারতের এসটিইউপি কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড, যুক্তরাজ্যের সিওডব্লিউআই কনসাল্টিং এবং বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস লিমিটেড ও ডেভ কনসালট্যান্টস লিমিটেড। জরিপে ধারণা করা হয়, সেতুটি দিয়ে ২০২৪ সালে ৬ হাজার ৯৯০, ২০৩৪ সালে ১৫ হাজার ৬২০ এবং ২০৫৪ সালে ৫৬ হাজার ৭০১টি গাড়ি চলাচল করবে। সম্প্রতি, বিবিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী মুহাম্মদ ফেরদৌস গণমাধ্যমকে বলেছেন, “জরিপ করা হলেও আমরা তাদের আরও কিছু পর্যালোচনা করতে বলেছিলাম। আশা করি তাদের কাজ শিগগিরই শেষ হবে।” তিনি আরও বলেছেন, “আমরা ইআরডিকে অনুরোধ করবো অর্থায়ন করতে আগ্রহীদের খুঁজে বের করতে।” সরকারের পক্ষ থেকে ইআরডি বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে থাকে। মুহাম্মদ ফেরদৌস জানিয়েছেন, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া ইতোমধ্যে প্রকল্পটি অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত ভোলা-বরিশাল সেতুতে রেললাইন না থাকায় এর ব্যয় পদ্মাসেতুর থেকে অনেক কম হবে। বর্তমানে পদ্মাসেতুর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। মুহাম্মদ ফেরদৌস বলেছেন, “এখন পর্যন্ত জরিপ বলছে যে, নদী শাসনের জন্য তেঁতুলিয়া নদী পদ্মার মতো কঠিন হবে না।”
Leave a Reply